ফরেন সার্ভিস একাডেমি, ঢাকা—৫ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিভিন্ন ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠক শেষে ফটোসেশনে অংশ নেন। ছবি


ধর্মীয় নেতাদের শান্তি ও সম্প্রীতির পক্ষে ঐক্যবদ্ধ থাকার ঘোষণা

রাজনীতিকদের পর এবার ধর্মীয় নেতারাও দেশে শান্তি, সম্প্রীতি এবং স্বাধীন অস্তিত্ব ও মর্যাদা রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। একই সঙ্গে তাঁরা দেশবিরোধী যেকোনো ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় অন্তর্বর্তী সরকারের পাশে থাকার আশ্বাসও দিয়েছেন।

আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সংলাপে এ অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন দেশের বিশিষ্ট আলেম, ইসলামি চিন্তাবিদ এবং হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টধর্মের নেতারা। সংলাপটি বিকেল সাড়ে চারটায় বাংলাদেশ ফরেন সার্ভিস একাডেমি মিলনায়তনে শুরু হয়ে সন্ধ্যা পৌনে সাতটায় শেষ হয়।

হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের অভিযোগে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনের মধ্যেই এই সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে বুধবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এবং মঙ্গলবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা সংলাপ করেন। জাতীয় ঐক্যের লক্ষ্যে চলমান এই আলোচনার শেষ পর্বে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন, বিশেষ করে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সঙ্গে বৈঠকের মাধ্যমে সংলাপ শেষ হবে বলে জানা গেছে।

সংলাপের শুরুতে ড. ইউনূস ধর্মীয় নেতাদের খোলামেলা আলোচনার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “প্রকৃত তথ্য জানা ও তাৎক্ষণিক সমাধানের ব্যবস্থা করতে হবে। এত বড় দেশে যে কোনো ঘটনা ঘটতে পারে, কিন্তু প্রকৃত ঘটনা জানা জরুরি। অপরাধী যে-ই হোক, তাকে বিচারের আওতায় আনাই সরকারের দায়িত্ব।”

সংলাপে ধর্মীয় নেতাদের সম্প্রীতির অঙ্গীকার

জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব মুফতি আবদুল মালেকসহ ১৬ জন বিশিষ্ট আলেম, হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টান ধর্মের নেতারা বৃহস্পতিবার বিকেলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সংলাপে অংশ নেন।

উপস্থিত আলেম ও ইসলামি নেতারা:
সংলাপে উপস্থিত ছিলেন কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব সাজেদুর রহমান এবং কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ—মুহিউদ্দিন রাব্বানী, আহমদ আলী কাসেমী, জুনায়েদ আল হাবিব ও মুনির হোসাইন কাসেমী।
এছাড়া বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের (বেফাক) মহাসচিব মাহফুজুল হক, আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা শায়খ আহমদুল্লাহ, মিরপুরের আরজাবাদ মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল বাহাউদ্দীন জাকারিয়া, ফরিদাবাদ মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা আবদুল কুদ্দুছ, লালবাগ মাদ্রাসার মুহাদ্দিস মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন রাজি, ছারছিনার দরবার শরিফের প্রতিনিধি ওসমান গণি সালেহী, আহলে হাদিসের প্রতিনিধি আবদুল্লাহ বিন আবদুর রাজ্জাক, এবং মোহাম্মদপুরের কাদেরিয়ার তৈয়বিয়া আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ জসিম উদ্দিন আল আজহারী।

অন্য ধর্মীয় নেতাদের মধ্যে:
রমনার সেন্ট মেরিজ ক্যাথিড্রালের প্রধান পুরোহিত ফাদার আলবাট রোজারিও, সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের সিস্টার রেভা ভেরোনিকা ডি কস্তা, বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট ফেডারেশনের উপদেষ্টা অধ্যাপক সুকমল বড়ুয়া, সাধারণ সম্পাদক ভিক্ষু সুনন্দ প্রিয়, রমনার হরিচাঁদ মন্দিরের ধর্মীয় সহসম্পাদক অবিনাশ মিত্র, এবং গারো সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি খামাল জনসন মৃ সংলাপে অংশ নেন।

সংলাপে সরকারের উপদেষ্টা আ ফ ম খালেদ হোসেন, আদিলুর রহমান খান, মাহফুজ আলম, সুপ্রদীপ চাকমা এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহারও সংলাপে অংশ নেন।

বক্তব্য ও প্রতিশ্রুতি

সংলাপে মুফতি আবদুল মালেক বলেন, "আমরা সম্প্রীতিতে বিশ্বাসী। সম্প্রীতি আছে বলেই আমরা মিলেমিশে বসবাস করছি। কিন্তু প্রতিবেশী দেশে সংখ্যালঘু মুসলমানরা এমন নিরাপত্তা পাচ্ছে না।"

হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব সাজেদুর রহমান বলেন, "সংখ্যাগরিষ্ঠ অমুসলিম নেতারা স্বীকার করেছেন যে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন হচ্ছে না। আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রয়েছে। চট্টগ্রাম ও ফরিদপুরে মুসলমান হত্যার মতো ঘটনা ঘটলেও কোনো দাঙ্গা হয়নি। দেশের বিরুদ্ধে যেকোনো ষড়যন্ত্র আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করব।"

ধর্মীয় নেতারা একমত হয়েছেন যে বাংলাদেশ একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ, যেখানে সব ধর্মের মানুষ মিলেমিশে শান্তিতে বসবাস করছে।

                                      ধর্মীয় নেতৃন্দের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান বৃউপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি


সংলাপে ধর্মীয় নেতাদের ঐক্যের বার্তা

ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে সংলাপ শেষে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন বলেন, "বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। ইসলাম শান্তি ও সম্প্রীতির কথা বলে। আমরা ধর্ম প্রচারের সময় এই বার্তাই দিই। সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য সরকার যদি সহযোগিতা চায়, আমরা প্রস্তুত।"

শায়খ আহমদুল্লাহ বলেন, "এই দেশের ওলামায়ে কেরাম অত্যন্ত দায়িত্বশীল। আইনজীবী সাইফুল হত্যাকাণ্ডের পরও মুসলমানরা ধৈর্য ও সংযম দেখিয়েছে। আমরা ঐক্যবদ্ধ, আমাদের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই।"

রমনার সেন্ট মেরিজ ক্যাথিড্রালের ফাদার আলবাট রোজারিও বলেন, "রাজনৈতিক দলগুলো যে ঐক্যের কথা বলেছে, আমরাও সেই বক্তব্যের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছি। কঠিন সময়ে আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। ইসকন ইস্যুতে হিন্দু সম্প্রদায়ের ক্ষোভ নিরসনের আহ্বান জানিয়েছি। আন্তর্জাতিক সংলাপের মাধ্যমে বিশ্বকে জানাতে হবে যে আমরা সম্প্রীতির মানুষ।"

সিস্টার রেভা ভেরোনিকা ডি কস্তা বলেন, "আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছি এবং এই দেশকে সম্প্রীতির দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। মিডিয়া যেন ভুল ও উসকানিমূলক সংবাদ প্রচার না করে। যুবসমাজকে ধৈর্যশীল ও সংযত থাকার আহ্বান জানাই।"

ভিক্ষু সুনন্দ প্রিয় বলেন, "বাংলাদেশে আমরা ভালো আছি, কোনো সমস্যা নেই। ভারতীয় গণমাধ্যম কী বলছে, সেটা তাদের বিষয়। আমাদের মূল বিষয় হলো আমরা কী প্রচার করছি এবং আমরা শান্তিতে আছি।"

অধ্যাপক সুকমল বড়ুয়া বলেন, "ঢাকায় থাকা কূটনৈতিক মিশনগুলো যেন দেখে আমরা শান্তির মেলবন্ধনে আছি। বিশ্ব জানুক, বাংলাদেশ একটি সম্প্রীতির দেশ। আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকতে চাই।"

অবিনাশ মিত্র বলেন, "কিছু লোক ভারত থেকে বিভেদ ছড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু বাংলাদেশে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও মুসলিম সম্প্রদায় একত্রিত রয়েছে। আমাদের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই।"

সংলাপে অংশ নেওয়া নেতারা দেশের বিরুদ্ধে যেকোনো ধরনের অপপ্রচার রুখতে রাষ্ট্রীয়ভাবে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেন।

যত অপপ্রচারই হোক, বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে

উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেছেন, “জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর গঠিত সরকার যেকোনো ষড়যন্ত্র কঠোরভাবে দমন করবে। হঠকারী পদক্ষেপ বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের কোনো ধরনের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া হবে না।”

তিনি আরও বলেন, “আমরা দেশের অভ্যন্তরীণ সংহতি ও শক্তি বৃদ্ধি করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাহ্যিকভাবে যতই ষড়যন্ত্র হোক না কেন, যদি আমরা রাজনৈতিক এবং সম্প্রদায়গতভাবে ঐক্যবদ্ধ থাকি, তাহলে কোনো অপপ্রচারই আমাদের অগ্রযাত্রা থামাতে পারবে না। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে—এটাই প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বার্তা।”