উন্নয়ন প্রকল্পের আড়ালে ১৫ বছরে ৩ লাখ কোটি টাকা লুটপাট
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে খরচ হয়েছে প্রায় ৭ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। তবে এই অর্থের ২৩ থেকে ৪০ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় পৌনে ৩ লাখ কোটি টাকা অপচয় ও লুটপাট হয়েছে বলে একটি শ্বেতপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, রাজনৈতিক চাঁদাবাজি, ঘুষ, এবং প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয় দেখিয়ে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতারা ও তাদের সুবিধাভোগীরা এই বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।
শ্বেতপত্রের মূল্যায়ন
অর্থনীতির বিভিন্ন খাত বিশ্লেষণ করে শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর যথাযথ তদারকি না থাকায় বড় ধরনের দুর্নীতি, অনিয়ম এবং অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদ অপচয় হয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে এডিপির আওতায় খরচ হওয়া প্রায় ৬ হাজার কোটি ডলার (বর্তমান বাজারমূল্যে ৭ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা) উন্নয়নে ব্যয়ের পরিবর্তে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের স্বার্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যদি এই অর্থ যথাযথভাবে ব্যবহার করা হতো, তাহলে দেশের অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন অনেক বেশি টেকসই হতো।
উন্নয়ন প্রকল্পে লুটপাট: ১.৬১ লাখ থেকে ২.৮০ লাখ কোটি টাকা অপচয়
বিগত ১৫ বছরে উন্নয়ন প্রকল্পের নামে প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি থেকে ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার কোটি থেকে ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা) চাঁদাবাজি, ঘুষ এবং বাড়তি খরচের নামে অপচয় হয়েছে বলে শ্বেতপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
নেতৃত্বহীন প্রতিযোগিতা ও ‘প্রেস্টিজ’ প্রকল্প
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, "উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে সরকারি বিনিয়োগের বিপুল অংশ অপচয় হয়েছে। অনেক প্রকল্পের অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।"
তিনি আরও জানান:
- প্রকল্পের মেয়াদ বারবার বাড়ানো হয়েছে, যার ফলে ব্যয় অপ্রয়োজনে বেড়েছে।
- প্রতিযোগিতাহীনভাবে পছন্দের ঠিকাদারদের কাজ দেওয়া হয়েছে, যা প্রকল্পের মান ও স্বচ্ছতায় ঘাটতি সৃষ্টি করেছে।
- ক্ষমতাসীনদের ‘প্রেস্টিজ প্রকল্প’ হিসেবে পরিচিত অনেক উদ্যোগে লোক দেখানো উন্নয়ন হয়েছে, কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নে নানাভাবে ‘নয়-ছয়’ করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যথাযথ অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ ও জবাবদিহিতার অভাবে এই অপচয় দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতন, ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সাড়ে ১৫ বছরের আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান।
এরপর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের দায়িত্ব নেয়। নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরই অর্থনীতির বর্তমান চিত্র তুলে ধরতে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়।
এই কমিটির নেতৃত্বে রয়েছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর সম্মাননীয় ফেলো ও খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
আজ রোববার, প্রধান উপদেষ্টার কাছে কমিটি আনুষ্ঠানিকভাবে অর্থনীতি বিষয়ক শ্বেতপত্র প্রতিবেদন তুলে দেবে।
"কোনো অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই ক্ষমতাসীনরা লোকদেখানো ‘প্রেস্টিজ’ প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপে বিভিন্নভাবে ‘নয়ছয়’ করা হয়েছে।"
— দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান।
রাজনৈতিক স্বার্থে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প ও লুটপাট
বিগত সরকারের আমলে রাজনৈতিক বিবেচনায় বহু অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এসব প্রকল্পে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত ব্যয় দেখিয়ে অর্থ অপচয় করা হয়েছে।
পছন্দের ঠিকাদার ও ঘুষের মাধ্যমে কাজ
- নিজেদের ঘনিষ্ঠ ঠিকাদারদের প্রতিযোগিতাহীনভাবে কাজ দেওয়া হয়েছে, যাঁদের সঙ্গে প্রভাবশালী মন্ত্রী ও এমপিদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।
- অনেক ঠিকাদার ঘুষ দিয়ে কাজের বরাদ্দ পেয়েছেন, ফলে প্রকল্পের গুণগত মান নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।
- কাজ শেষ হওয়ার আগেই ঠিকাদাররা বিল তুলে নেওয়ার ঘটনাও একাধিকবার ঘটেছে।
প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি ও অর্থ লুটপাট
প্রকল্পগুলোর ব্যয় ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটপাট করা হয়েছে। ফলে, প্রকল্পগুলো কার্যকরভাবে শেষ হওয়ার বদলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে, কিন্তু দেশের সার্বিক উন্নয়ন তেমনভাবে ঘটেনি।
উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন বাজেটের ব্যবহার
সরকার প্রতি বছর দুটি বাজেট প্রণয়ন করে:
- উন্নয়ন বাজেট:
- এ বাজেটের অর্থ নতুন ও চলমান প্রকল্পে খরচ করা হয়।
- প্রতিবছর গড়ে ১,০০০টির বেশি প্রকল্প এই বাজেটের আওতায় বাস্তবায়িত হয়।
- অনুন্নয়ন বাজেট:
- এ বাজেট দিয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, দেশি-বিদেশি ঋণ পরিশোধ, এবং অন্যান্য অবধারিত ব্যয় পরিচালিত হয়।
অর্থনীতিবিদদের মতে, উন্নয়ন বাজেটে প্রকল্পের কার্যকারিতা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত না হওয়ায় অর্থনৈতিক অপচয় এবং লুটপাটের ঘটনা বারবার ঘটেছে।
অর্থের অপচয় এবং প্রকল্পে লুটপাটের উদাহরণ
উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর মধ্যে নানাভাবে অর্থের অপচয় এবং লুটপাট হয়ে থাকে। এর অন্যতম কারণ হলো প্রভাবশালী মন্ত্রী, এমপি, এবং আমলাদের ইচ্ছায় প্রকল্প গ্রহণ করা। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে নিজস্ব এলাকা বা রাজনৈতিক সুবিধা লাভ করতে চেষ্টা করা হয়।
এছাড়া, প্রকল্পের ঠিকাদারি সাধারণত প্রভাবশালীদের পছন্দের ব্যক্তি বা সংস্থার কাছে যায়, যা প্রকল্পের বাস্তবায়ন এবং গুণগত মানে প্রভাব ফেলে।
উদাহরণ: বাল্লা স্থলবন্দর প্রকল্প
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী আমলা এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব অশোক মাধব রায় ২০১৬ সালে হবিগঞ্জ জেলায় বাল্লা স্থলবন্দর উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেন।
- ৪৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা খরচ করে ভবন, ইয়ার্ড, ওজন যন্ত্রসহ নানা অবকাঠামো তৈরি করা হয়।
- তবে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পর ভারতের দিকে কোনো স্থলবন্দর নেই, যার ফলে বাল্লা স্থলবন্দরটি অকার্যকর হয়ে পড়ে।
- আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিদের সুপারিশে আরও সাতটি স্থলবন্দরের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। কিন্তু,
- কোনোটিতেই বাণিজ্য বাড়েনি,
- কোনোটি চালু হয়নি।
- অথচ, এই প্রকল্পগুলোর জন্য শত শত কোটি টাকা খরচ হয়েছে।
এটি স্পষ্টভাবে তুলে ধরে যে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও ব্যক্তিগত সুবিধা লাভের জন্য প্রকল্পের বাস্তবায়ন এবং অর্থের অপচয় একটি বড় সমস্যা হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
অপচয় ও লুটপাট: বড় প্রকল্পের বাস্তবায়ন ও খরচ
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বেশ কয়েকটি বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়, যার জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। তবে এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন এবং খরচের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
পদ্মা রেলসংযোগ সেতু ও দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ
- পদ্মা রেলসংযোগ সেতু নির্মাণ প্রকল্প-এ ৩৯ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ করা হলেও, বর্তমানে দিনে মাত্র ১০টি ট্রেন চলে।
- দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণে ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ হয়েছে, কিন্তু সেখানে মাত্র ৬টি ট্রেন চলে।
- এসব প্রকল্পে সম্ভাব্যতা যাচাই নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও অর্থ উত্তোলন
- বেশিরভাগ রেল প্রকল্পের কাজ পেয়েছে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো।
- অনেক ক্ষেত্রে কাজ না করেই অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র
- রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যয়, ঋণচুক্তি, ও সম্ভাব্যতা যাচাই নিয়ে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
- প্রকল্পের খরচ বারবার সংশোধন করা হয়েছে, যার ফলে সময়সীমা ও অর্থের অপচয় হয়েছে।
দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথের ব্যয় বৃদ্ধি
- ২০১০ সালে দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণে প্রথম খরচ ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা।
- তবে প্রকল্পটি দুবার সংশোধন করে বর্তমানে ১১ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকায় বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, যার ফলে খরচ বেড়েছে ৫১২ শতাংশ।
অর্থের অপচয়: ভবন নির্মাণ ও অতিথিশালা
- বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ভবন নির্মাণের নামে শত শত কোটি টাকা অপচয় হয়েছে।
- কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় ৪৫০ কোটি টাকা খরচ করে সাত তারকা মানের অতিথিশালা নির্মাণ করা হয়েছে।
- কক্সবাজার রেলস্টেশনে পর্যটকদের জন্য অতিথিশালা নির্মাণ করা হলেও, তা চালু হয়নি।
এই প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে শুধু অর্থের অপচয় হয়নি, বরং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্য জনগণের উন্নয়ন পিছিয়ে গেছে।
এডিপির আকার ১০ গুণ বৃদ্ধি: আওয়ামী লীগের ১৫ বছরে
আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ১০ গুণ বাড়ানো হয়েছে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পরের অর্থবছরে (২০০৯-১০), তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২৮,০০০ কোটি টাকা এডিপি নির্ধারণ করেছিলেন। এরপর, প্রতিবছরই এডিপির আকার বৃদ্ধি পেয়েছে।
এভাবে, উন্নয়ন প্রকল্পের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। বর্তমানে, চলতি অর্থবছরে এডিপির আকার দাঁড়িয়েছে ২,৭৮,২৮৯ কোটি টাকা।
0 Comments