উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো ব্যক্তিদের শোকাহত পরিবারের দুই সদস্য। ঘটনাস্থল দক্ষিণ কোরিয়ার মুয়ান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪। ছবি: এএফপি।
দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু এয়ারের ফ্লাইট ২২১৬ দুর্ঘটনার পর যাত্রীবাহী উড়োজাহাজে পাখির আঘাতজনিত ঝুঁকির বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে। দক্ষিণ কোরিয়ার ভূমি, অবকাঠামো ও পরিবহন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, পাইলটরা বিপজ্জনক পরিস্থিতি (মে–ডে) ঘোষণার ঠিক আগে উড়োজাহাজের একটি পাখির ঝাঁকের সঙ্গে সংঘর্ষের কথা জানিয়েছিলেন। সংঘর্ষের পর উড়োজাহাজটি মুয়ান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণের চেষ্টা করে।
গতকাল রোববারের ওই দুর্ঘটনার ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, বোয়িং ৭৩৭-৮০০ মডেলের দুই ইঞ্জিনবিশিষ্ট উড়োজাহাজটি অবতরণের সময় গিয়ার চালু না করে ইঞ্জিনের নিচের অংশ দিয়ে (বেলি-ফ্লপ ল্যান্ডিং) নামার চেষ্টা করে।
উড়োজাহাজটি রানওয়ে থেকে ছিটকে পড়ে একটি দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে বিস্ফোরিত হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে আগুন ধরে যায়। এতে ১৮১ আরোহীর মধ্যে ১৭৯ জন প্রাণ হারান।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বড় পাখির সঙ্গে সংঘর্ষ উড়োজাহাজের জন্য মারাত্মক হুমকি হতে পারে। তবে শুধুমাত্র পাখির আঘাতের কারণে কোনো উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হওয়া একেবারেই বিরল ঘটনা বলে তারা মনে করেন।
কনসালটেন্সি অ্যাভিয়েশন সেফটি এশিয়ার পরিচালক ডেন উইলিয়ামস জানিয়েছেন, বোয়িং ৭৩৭-৮০০ মডেলের মতো আধুনিক উড়োজাহাজের পাখির আঘাতে বিধ্বস্ত হওয়া প্রায় অসম্ভব।
আল-জাজিরার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ডেন উইলিয়ামস বলেন, বোয়িংয়ের ইঞ্জিনগুলো এমনভাবে নকশা করা হয়েছে যাতে অপরিচিত বস্তু বা প্রতিবন্ধকতা দূরে সরিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়।
অস্ট্রেলিয়া-ভিত্তিক এয়ারলাইন রেটিংয়ের প্রধান সম্পাদক জিওফ্রে থমাস মনে করেন, পাখির আঘাত এই দুর্ঘটনার আংশিক কারণ হতে পারে। তিনি আরও বলেন, উড়োজাহাজটিতে সম্ভবত বৈদ্যুতিক গোলযোগ হয়েছিল। কারণ, মে–ডে ঘোষণার পরপরই নিয়ন্ত্রণকক্ষে উড়োজাহাজটির অবস্থানগত তথ্য সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এই অবস্থানগত তথ্য সরবরাহ ব্যবস্থাটি ‘এডিএস-বি ডেটা’ নামে পরিচিত।
জিওফ্রে থমাস আল-জাজিরাকে জানান, “পাইলটরা একাধিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন বলে মনে হলেও সেগুলোর প্রকৃত ধরন এখনো পরিষ্কার নয়। যা জানা যাচ্ছে তা হলো, এডিএস-বি ডেটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, এবং পাইলটরা অবতরণের সময় উড়োজাহাজের নিচের গিয়ার বা ধাক্কা প্রতিরোধব্যবস্থা (আন্ডারক্যারেজ) ব্যবহার করেননি।
“এসব কেন ঘটেছিল, তা এখনো অজানা। তবে পাখির ঝাঁকের কারণে বিপদ সংকেত দেওয়ার পরপরই এসব ঘটনা ঘটে,” যোগ করেন তিনি।
দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ এই উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার কারণ উদঘাটনে তদন্তকারীদের কয়েক মাস সময় লাগতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
দেশটির কর্তৃপক্ষ দুর্ঘটনাটি বিশদভাবে তদন্ত করছে। বৈশ্বিক উড়োজাহাজ আইনের আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পরিবহন নিরাপত্তা বোর্ডও (এনটিএসবি) তদন্তে অংশ নিয়েছে, কারণ দুর্ঘটনার শিকার বোয়িং উড়োজাহাজটি যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি।
যাত্রীবাহী উড়োজাহাজে পাখির আঘাত একটি সাধারণ সমস্যা। তবে এ ধরনের আঘাত থেকে গুরুতর দুর্ঘটনার ঘটনা খুবই বিরল।
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল অ্যাভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফএএ) তথ্যমতে, ২০২৩ সালে দেশটির বিমানবন্দরগুলোয় ১৯ হাজার ৪০০টি পাখিসহ বাহ্যিক আঘাতের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। একই সময়ে বিশ্বের ৫৫টি দেশে এ ধরনের ২৩৬টি আঘাতের ঘটনা জানিয়েছে মার্কিন উড়োজাহাজ সংস্থাগুলো।
দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের প্রতি মাথা নিচু করে ক্ষমা প্রার্থনা করছেন জেজু এয়ারের এক কর্মকর্তা। স্থান: মুয়ান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪। ছবি: এএফপি।জিওফ্রে থমাসের মতে, পাখির আঘাতের অধিকাংশ ঘটনায় গুরুতর ক্ষতি না হয়ে সাধারণত উড়োজাহাজে সামান্য ক্ষতি হয়। তবে এসব ঘটনার কারণে বিশ্বজুড়ে উড়োজাহাজশিল্পের বছরে প্রায় ১৫০ কোটি মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়।
তিনি বলেন, উড়োজাহাজে যাত্রী চলাচল বৃদ্ধির সঙ্গে পাখির আঘাতের ঘটনাও বেড়েছে। বর্তমানে সারা বিশ্বে প্রতিদিন ১ লাখ ২০ হাজারের বেশি যাত্রীবাহী ফ্লাইট পরিচালিত হয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থার তথ্যমতে, পাখির আঘাতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে উড়োজাহাজগুলোতে গুরুতর কোনো সমস্যা দেখা যায় না।
গতকাল সকাল ৯টার কিছু পর দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু এয়ারের একটি উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়। উড়োজাহাজটিতে ১৭৫ যাত্রী এবং ৬ জন ক্রু মিলিয়ে মোট ১৮১ জন আরোহী ছিলেন। এদের মধ্যে দুজনকে জীবিত উদ্ধার করা গেলেও বাকি সবাই নিহত হন। নিহতদের মধ্যে ১৪১ জনের মরদেহ শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে।
দক্ষিণ কোরিয়া বর্তমানে গভীর রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। মাত্র এক মাসের মধ্যে দেশটি তিনজন প্রেসিডেন্ট দেখেছে। বর্তমান ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট চোই সাং মক দায়িত্ব গ্রহণের তিন দিনের মাথায় এই দুর্ঘটনা ঘটে। তিনি ইতোমধ্যে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে হতাহত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন।
আজ সোমবার থেকে দেশটিতে সাত দিনের শোক পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছে। এ ছাড়া, দক্ষিণ কোরিয়ায় বোয়িং ৭৩৭-৮০০ মডেলের সব উড়োজাহাজের ওপর বিশেষ তদন্ত চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
0 Comments